একই শহরের মধ্যে যেন অনেকগুলো শহরের অস্তিত্ব। প্রগতিশীল, উদার পরিবেশ থাকলেও কলকাতাকে অনেকটা এ ভাবেই দেখে থাকেন সমাজ-ইতিহাসবেত্তা পণ্ডিতদের একাংশ। দেশভাগের পর থেকেই এ শহরে ক্রমশ হিন্দু বা মুসলিমদের মহল্লাগুলি আলাদা হয়েছে। ছোট ছোট খোপে যেন বন্দি হয়েছেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। নতুন যুগের কলকাতায় কিন্তু এমন বিভাজনরেখা ভাঙতেও দেখা যায়। এ বার নিউ টাউনে আসন্ন ইদের নমাজ সমাবেশের আয়োজনে তা কিছুটা স্পষ্ট হচ্ছে।
গত বছর থেকেই ইদের নমাজে শামিল হচ্ছেন নিউ টাউনের বাসিন্দাদের একাংশ। কিন্তু এই আয়োজনের নেপথ্যে মুসলিম পড়শি, বন্ধুদের দোসর স্থানীয় হিন্দুরা অনেকেই। ‘নিউ টাউন সিটিজেন্স ফোরাম’ নামে একটি নাগরিক মঞ্চের সাংস্কৃতিক সচিব দীপক বিশ্বাসের সঙ্গে মঙ্গলবার এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। অঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক দীপক বলছিলেন, “নিউ টাউনে বেশ কয়েকটি দুর্গাপুজো হলেও মুসলিমদের অনুষ্ঠানের চিহ্ন ছিল না। মুসলিম বন্ধুরা পাশের গ্রামে বা কলকাতার অন্যত্র মসজিদে ইদের নমাজ পড়তে যেতেন। ওঁদের পাশাপাশি ফোরামের হিন্দু সদস্যেরাও বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন।”
গত বছর রমজান শেষের ইদে নিউ টাউন কলকাতা ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (এনকেডিএ) হলঘরে নমাজ পড়ার পরে দেখা গিয়েছিল, কমিউনিটি হলে অত লোক ধরাটাই মুশকিল। কুরবানির ইদে একটি শপিং মলের পাশের মাঠে নমাজ পড়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু সেই মাঠে সৌন্দর্যায়নের কাজ চলায় এ বছর কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইদের নমাজের আহ্বায়ক, বায়ুসেনার অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ হুমায়ুন সিরাজ, ফোরামের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক লুৎফুল আলমেরা বলছিলেন, শেষ পর্যন্ত নিউ টাউন বইমেলার মাঠে এ বার নমাজ পড়ার ছাড়পত্র মিলেছে। সম্ভবত কাল, বৃহস্পতিবার সেখানে নমাজে শামিল হবেন স্থানীয় নরনারী।
সিরাজের কথায়, “ওই মাঠে নমাজ পড়ার অনুমতি পেতে এনকেডিএ-কে ২৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। ইদ-উল-ফিতরের পরে কুরবানির ইদেও সেখানেই নমাজ পড়া হবে। তবে আমাদের হিন্দু বন্ধুরাও অনেকে এগিয়ে এসে নমাজের অনুষ্ঠানের জন্য বেশ কিছুটা চাঁদা দিয়েছেন। রমজানে এক দিন সবাই একসঙ্গে ইফতার করেছিলাম, তখনও হিন্দু বন্ধুরা কেউ কেউ নানা আয়োজনের মধ্যে ছিলেন।”
লুৎফুল আলমের কথায়, “কলকাতার অন্যত্র ঘর ভাড়া পেতে মুসলিমদের সমস্যা এই দিকটায় কম। আবার, মুসলিমরাও এখানে পাঁচমিশেলি পাড়ায় থাকতে সড়গড়। আর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও হিন্দু, মুসলিমের মেলামেশা দারুণ স্বতঃস্ফূর্ত।” ফোরামের উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারি, পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীও হয়। রমজান শেষের ইদের নমাজে মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দুরাও থাকছেন স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায়। নমাজ শেষে সবাই একসঙ্গে শরবত সহযোগে মিষ্টিমুখ হবে।
দীপকের কথায়, “গত বছরের আগে ইদের নমাজ কখনও দেখিনি। এমন সুন্দর শৃঙ্খলা দেখতে ভাল লাগে! ইমাম সাহেবের উপদেশের দেশপ্রেম, ভ্রাতৃত্বের কথাগুলিও সুন্দর!” লুৎফুল বলছিলেন, ‘‘ইদের নমাজের অনুষ্ঠানে আমি, সিরাজদা, ইয়াসমিন রহমানদের সঙ্গে মোহিনীমোহন সরকার, সমীর গুপ্ত, শাশ্বতী বিশ্বাস বা দীপকদা-দের বাদ দিয়েও এখন ভাবতে পারি না!”