বাংলায় মহাজঙ্গলরাজ চলছে। বিজেপিকে একবার সুযোগ দিন, দেখুন কী উন্নয়ন করি। বিহারে জঙ্গলরাজ উপড়ে ফেলেছি, এবার বাংলা থেকেও উপড়াব। তিলোত্তমার মাটি থেকে এভাবেই শাসকদল তৃণমূলকে বেনজির ভাষায় আক্রমণ শানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নদিয়ার তাহেরপুরে সরাসরি পৌঁছাতে না পারলেও কলকাতা বিমানবন্দর থেকে ফোনে দেওয়া তাঁর ১৬ মিনিটের সংক্ষিপ্ত অথচ তীক্ষ্ণ ভাষণ বঙ্গ রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ বাড়িয়ে দিল । মোদী স্পষ্ট করে দিলেন, এবার তাঁর লক্ষ্য নবান্ন থেকে তৃণমূলের আধিপত্যের অবসান ঘটানো।শনিবারের এই রাজনৈতিক রণকৌশলটি ছিল আদ্যোপান্ত ঝোড়ো গতির। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মিলিয়ে প্রায় ৭৫ মিনিটের বড় মাপের সভা করার পরিকল্পনা থাকলেও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে মোদীর হেলিকপ্টার তাহেরপুরে নামতে ব্যর্থ হয়। ফিরে আসতে হয় কলকাতা বিমানবন্দরে। কিন্তু সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারলেও আক্রমণের ধার কমেনি একটুও।
বিমানের ককপিট বা বিমানবন্দরের লাউঞ্জ থেকেই ফোনের মাধ্যমে যখন তাঁর গলা মাইক্রোফোনে বেজে উঠল, তখন তাহেরপুরের মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। মোদী সরাসরি বললেন, পশ্চিমবঙ্গে এখন যা চলছে তা কেবল অরাজকতা নয়, বরং ‘মহাজঙ্গলরাজ’। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিহার ও ত্রিপুরার উদাহরণ। তিনি দাবি করেন, বিহারে এনডিএ সরকার আসার পর যেভাবে সেখান থেকে অপরাধ ও বিশৃঙ্খলার রাজত্ব বিদায় নিয়েছে, বাংলাতেও সেটা সফল করতে চায় বিজেপি। তাঁর আক্ষেপ, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বামেদের ৩৪ বছরের দুঃশাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিল, কিন্তু তৃণমূল সেই সব খারাপ অভ্যাস আর খারাপ মানুষগুলোকে আপন করে নিয়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। মোদীর কথায়, ত্রিপুরার মানুষ বামেদের বিদায় দিয়ে বিজেপিকে বেছে নিয়ে আজ উন্নয়নের পথে দ্রুত হাঁটছে, অথচ বাংলা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। বক্তৃতায় অত্যন্ত আক্রমণাত্মক সুরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তৃণমূল সরকার তাঁর হাজার হাজার কোটি টাকার কেন্দ্রীয় প্রকল্প আটকে রেখেছে।
তিনি বারবার প্রশ্ন তোলেন, মোদীর বিরোধ করতে গিয়ে রাজ্যের উন্নয়ন কেন আটকানো হচ্ছে? তাঁর দাবি, মোদী বিরোধিতার নামে বাংলার মানুষের স্বপ্ন নিয়ে খেলা করা হচ্ছে, আর এই পাপের ফল তৃণমূলকে ভোগ করতে হবে। তিনি তৃণমূলকে বলেন, মোদি বিরোধিতা করুন,বার বার করুন,হাজার বার করুন কিন্তু বাংলার উন্নয়ন বন্ধ করবেন না । তিনি বাংলার মানুষকে হাতজোড় করে অনুরোধ করেন একবার ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। মোদী প্রতিশ্রুতি দেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে দ্রুততার সঙ্গে বাংলার চেহারা বদলে যাবে। গঙ্গা যেমন বিহার হয়ে বাংলায় প্রবাহিত হয়, তেমনই বিহারের পরিবর্তনের হাওয়াও বাংলার পালে লাগবে বলে তিনি হুঙ্কার দেন। এদিন আক্রমণের তালিকায় ছিল অনুপ্রবেশ ইস্যুও। তিনি বলেন, গণতন্ত্রে হার-জিত থাকবেই, কিন্তু যারা ‘গো ব্যাক মোদী’ শ্লোগান তুলছে, তারা ‘গো ব্যাক অনুপ্রবেশকারী’ কেন বলতে পারছে না? তাঁর অভিযোগ, তৃণমূল সরকার অনুপ্রবেশকারীদের তোষণ করছে কারণ তারাই শাসকদলের আসল সম্পদ।
অনুপ্রবেশকারীরাই বাংলার সমাজব্যবস্থা দখল করতে চাইছে বলে তিনি সতর্ক করেন। ভাষণের শুরু ও শেষে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত কৌশলে নদিয়ার ধর্মীয় আবেগকেও ছুঁয়ে গিয়েছেন। ‘জয় নিতাই’ সম্বোধনের মাধ্যমে তিনি মতুয়া ও বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের মন জয়ের চেষ্টা করেন। যদিও সংক্ষিপ্ত ভাষণে মতুয়াদের এসআইআর নিয়ে উদ্বেগের বিষয়ে কোনো পরিষ্কার বার্তা না থাকায় সভায় উপস্থিত অনেকের মধ্যেই মৃদু অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেই খামতি মিটিয়ে দেন কয়েক ঘণ্টা পর তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় লেখেন, মতুয়া ও নমশূদ্র পরিবারগুলোর সেবায় বিজেপি সর্বদা নিয়োজিত থাকবে। সিএএ-র মাধ্যমে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার অধিকার বিজেপি রক্ষা করবে বলে তিনি বড় প্রতিশ্রুতি দেন। মতুয়ারা তৃণমূলের দয়ায় বাঁচবে না । রাজনৈতিক সভার পাশাপাশি এদিন মোদীর গলায় উঠে আসে বাংলার আবেগ ও সংস্কৃতির কথা।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বন্দে মাতরমকে তিনি ‘বিকশিত ভারতের মন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করেন। বঙ্কিমচন্দ্রকে ভুলবশত অতীতে ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করলেও এদিন সচেতনভাবে তাঁকে ‘ঋষি বঙ্কিমবাবু’ বলে সম্মান জানান। চৈতন্যদেবের প্রেম ও ঐক্যের বাণীর কথাও তাঁর মুখে শোনা যায়। এদিন সভার শুরুতেই মোদী দুঃখপ্রকাশ করেন সকালে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত বিজেপি কর্মীদের মৃত্যুতে। আবহাওয়ার কারণে সভায় না পৌঁছাতে পারার জন্য ক্ষমা চেয়েও তিনি বুঝিয়ে দেন,তাঁর রাজনৈতিক সংকল্প অটুট। বিকেলের পোস্টে তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে ফুটবল নিয়ে তৃণমূলকে তুলোধোনা করেন।
যুবভারতীতে একটি ফুটবল ইভেন্ট বাতিল হওয়া নিয়ে নাম না করে তিনি বলেন, তৃণমূলের দুর্নীতির জেরে আজ বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের মাথা নিচু হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে মোদীর ১৬ মিনিটের এই সংক্ষিপ্ত ডিজিটাল ভাষণ ছিল আগাগোড়া আক্রমণাত্মক। একদিকে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখানো, অন্যদিকে জঙ্গলরাজের তকমা সেঁটে দিয়ে তৃণমূলের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। মোদীর বার্তা পরিষ্কার বাংলা এখন মুক্তি চাইছে, আর সেই মুক্তির চাবিকাঠি বিজেপির হাতেই রয়েছে। আগামীর বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই ভাষণ যে গেরুয়া শিবিরের কর্মীদের চাঙ্গা করার টনিক হিসেবে কাজ করবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই রাজনৈতিক মহলে।





